যাকাত দেওয়ার সঠিক নিয়ম: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে । যাকাত দেওয়ার নিয়ম: গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা মুসলিমদের জন্য

যাকাত এর নিয়ম:

যাকাত দেওয়ার সঠিক নিয়ম: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে । যাকাত দেওয়ার নিয়ম: গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা মুসলিমদের জন্য

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো যাকাত। এটি মুসলিমদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক ইবাদত, যার মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ গরিব ও অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করে। যাকাত মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে এবং সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে। নিচে যাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত নিয়ম আলোচনা করা হলো:


যাকাতের সংজ্ঞা

যাকাত শব্দটি আরবি "زكاة" থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ পবিত্রতা, বৃদ্ধি এবং আশীর্বাদ। ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী, এটি হলো সম্পদের এমন নির্দিষ্ট অংশ যা ধনী ব্যক্তিরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গরিব ও দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে।


যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলি

যাকাত আদায় করা ফরজ হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ হওয়া আবশ্যক:

  1. মুসলিম হওয়া: যাকাত শুধুমাত্র মুসলিমদের ওপর ফরজ।

  2. স্বাধীনতা: যাকাত আদায়ের জন্য ব্যক্তি স্বাধীন হওয়া আবশ্যক। দাস বা বন্দীদের ওপর যাকাত ফরজ নয়।

  3. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া: প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ) মুসলিমদের জন্য যাকাত ফরজ।

  4. আক্ল (বুদ্ধিমত্তা): মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরজ।

  5. সম্পদের মালিক হওয়া: যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, তার ওপর যাকাত ফরজ।

  6. এক বছর সম্পদ থাকা: নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক চন্দ্র বছর বা ১২ মাস ধরে মালিকানায় থাকতে হবে।


নিসাবের হিসাব

নিসাব হলো সেই ন্যূনতম সম্পদের পরিমাণ, যা কারো মালিকানায় থাকলে তার ওপর যাকাত ফরজ হয়। এটি মূলত দুটি প্রধান সম্পদের উপর নির্ভর করে:

  1. স্বর্ণ ও রূপা:

    • স্বর্ণের জন্য নিসাব: ৮৭.৪৮ গ্রাম (সাড়ে সাত তোলা)।

    • রূপার জন্য নিসাব: ৬১২.৩৬ গ্রাম (সাড়ে বায়ান্ন তোলা)।

  2. অর্থ ও ব্যবসায়িক সম্পদ:

    • যে কোনো নগদ অর্থ, ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ, শেয়ার, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদির মূল্য যদি রূপার নিসাব সমান বা তার বেশি হয়, তবে যাকাত ফরজ।


যাকাতের হার

যাকাতের নির্ধারিত হার হলো মোট সম্পদের ২.৫%। এটি সহজভাবে হিসাব করা যায়:


যাকাত আদায়ের যোগ্য সম্পদ

নিম্নলিখিত সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ হয়:

  1. স্বর্ণ ও রূপা:

    • অলংকার, বার বা অন্যান্য রূপে থাকা স্বর্ণ ও রূপা।

  2. নগদ অর্থ:

    • ব্যাংক ব্যালেন্স, নগদ টাকা।

  3. ব্যবসায়িক পণ্য:

    • ব্যবসার জন্য ক্রয়কৃত সামগ্রী।

  4. উৎপাদিত কৃষিপণ্য:

    • কিছু ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদনের ওপরও যাকাত ফরজ।

  5. প্রাণীসম্পদ:

    • গবাদিপশু যেমন উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি।

  6. শেয়ার ও বিনিয়োগ:

    • ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত শেয়ার বা অন্যান্য বিনিয়োগ।


যাকাত প্রদানের পদ্ধতি

  1. হিসাব নির্ধারণ:

    • নিজের মোট সম্পদের একটি তালিকা তৈরি করুন।

    • প্রয়োজনীয় খরচ ও দেনা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সম্পদের হিসাব করুন।

  2. যোগ্যতা নির্ধারণ:

    • নিশ্চিত করুন যে আপনার সম্পদ নিসাবের পরিমাণ অতিক্রম করেছে।

  3. লাভজনক কাজে বিতরণ:

    • যাকাত এমন ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করুন, যারা কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী প্রাপ্য।


যাকাতের উপযুক্ত গ্রহণকারী

কুরআনে যাকাত প্রদানের আটটি খাত নির্ধারণ করা হয়েছে:

  1. ফকির: যারা সম্পূর্ণ দরিদ্র।

  2. মিসকিন: যাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য নেই।

  3. যাকাত সংগ্রহকারী: যারা যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে।

  4. নতুন মুসলিম: যাদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়।

  5. দেনাগ্রস্ত ব্যক্তি: যারা বৈধ দেনার ভারে জর্জরিত।

  6. আল্লাহর পথে জিহাদকারী: যারা ইসলামি কার্যক্রমে নিয়োজিত।

  7. মুক্তির জন্য দাস: যারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায়।

  8. মুসাফির: যারা ভ্রমণে আর্থিক কষ্টে আছে।


যাকাত না দেওয়ার পরিণাম

যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ আছে। যেমন:

  1. কুরআনে বলা হয়েছে, "যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও" (সূরা তওবা: ৩৪)।

  2. হাদিসে এসেছে, "যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত আদায় করবে না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদকে তার জন্য বিষাক্ত সাপ বানিয়ে দেওয়া হবে" (বুখারি)।


উপসংহার

যাকাত শুধু ধনীদের দায়িত্ব নয়; এটি একটি সামাজিক বন্ধন যা দরিদ্রদের সহযোগিতা করে এবং সমগ্র সমাজে ন্যায়পরায়ণতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত করে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত নিয়মিতভাবে যাকাত আদায় করা এবং সমাজে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url